২০০৩ সালে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে হাতে নিয়ে একটি আট ফুট উচ্চতার হোয়াইট বোর্ড নিয়ে যেখানে সকল বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে টুকে রাখা যায়।  অগছালো মার্ক জাকারবার্গ ছোটবেলা থেকেই বেশ অগোছালো স্বভাবের তবে প্রচন্ড মেধাবী একজন ।

হার্ভার্ডে তার প্রথম প্রজেক্ট কোর্স ম্যাচ যেখানে দেখা যেতো কোন শিক্ষার্থী কোন কোর্সে এনরোলড আছে । প্রথম প্রজেক্টই বেশ সফল এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠে । পরের প্রজেক্টের গল্পটি আরও ইন্টারেস্টিং, মেয়েমহলে তুমুল  জনপ্রিয় মার্ক ধরাশয়ী হন একজন রমণীর কাছে। প্রত্যাখান হওয়া বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহন করতে পারেনি অহংকারী মার্ক । তাই পরের প্রজেক্টি অনেকটা জেদের বশেই করা ; যার নাম ছিলো ফেসম্যাশ। যেখানে দুজন মেয়ের ছবি থেকে তুলনা করে একটি ছবিতে ভোট দেওয়ার মতন প্রতিযোগীতা ছিলো ।আর এসব ছবি কালেক্ট করা হয়েছিলো হার্ভার্ডের সাইট থেকে এবং হ্যাকিং এর মাধ্যমে । মাত্র কয়েক মিনিটে ৪৫০ শিক্ষার্থী ২২ হাজার জোড়া ছবি তুলনা করে ফেলেছেন ।অবশেষে বর্ণবিদ্বেষের দায়ে হার্ভার্ড ডিসিপলিনারি কমিটি ডাক দেয় মার্ককে, ততক্ষনে অবশ্য তার ২টি প্রজেক্টই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলো ।

ফাসম্যাশের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ৯ টি শিক্ষার্থী দের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল হার্ভার্ডে নিজস্ব নিউজলেটারে একটি নিবন্ধন প্রকাশিত হয়।  মার্ক জাকারবাগ ভাবলেন এমন একটি ওয়েব সাইট নিয়ে ,যেখানে শিক্ষার্থীদের সকল কিছু থাকবে এবং ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করেন ।ডোমেইন হিসাবে নিবন্ধন করেন thefacebook.com। মার্ক এবং এডুয়ারডো স্যাভেরিন  দুইজনে প্রত্যেকেই ১০০০ ডলার করে বিনিয়োগ করেন। ২০০৪ সালে the facebook আত্মপ্রকাশ পায় এবং মার্কের কিছু বন্ধুকে জানান হয় । মস্কোভিচ  এর পরামর্শে মেইলিং লিস্টে এ খবর দেয়ায় ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেন

৬ দিন পর মার্কদের সিনিয়র ছাত্র ক্যামেরন উইস্কেল্ভস ও টেইলর উইস্কেল্ভস এবং দিব্য নরেন্দ্র মার্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন ,তাকে হায়ার করা হয়েছিলো হার্ভার্ড কানেকশন নামের সাইট বানিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু  তিনি তাদেরটা না বানিয়ে নিজের টা বানাচ্ছিল এক পর্যায়ে ৩জনকে কিছু শেয়ার দেয়ার মাধ্যমে ফয়সালা হয়।

১ম মাসেই প্রায় অধেক শিক্ষার্থী এখানে নিবন্ধন করে ফেলেন । জাকারবার্গ দল ভারী করেন ডাস্টিন মস্কোভিচ, এনড্র ম্যাককলাম ও ক্রিস হিউজেস দেরকে নিয়ে।

মার্চ, ২০০৪ সালে স্যানফোর্ড আর ইয়েলের এবং ক্রমান্বয়ে আইভি লীগের কলেজগুলোর জন্য ফেসবুক ছেড়ে দেওয়া হয়। নিবন্ধনের চাপের সঙ্গে সঙ্গে কাজ বেড়ে যাওয়ায় ক্যালিফোর্নিয়ার পলো অল্টোতে সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়।

সিন পার্কার অ্যাপ্রোচ করেন লিংকডইনের সিইও রিড হফম্যানকে। মার্কের সঙ্গে পিটারের কয়েক দফা মিটিংয়ের পর পিটার ১০.২% শেয়ারের বিপরীতে ৫ লাখ ডলারের বিনিয়োগ করেন। এর মধ্যে সার্ভারের খরচ তোলার জন্য মার্ক সাইটে বিজ্ঞাপন নেওয়াও শুরু করেছেন। তারপর দুই লাখ ডলারে facebook.com কিনে নিয়ে নাম থেকে The বাদ দেওয়া হয়।

২০০৫ সালের শুরু সিরিজ এ-এর বিনিয়োগকারী হিসেবে আসে এসেল পার্টনার। ৯৮ মিলিয়ন ডলারের ভ্যালুয়েশনে তারা ১২.৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। ডিসেম্বর নাগাদ ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয় ৬ মিলিয়ন। প্রথমে যুক্তরাজ্য এবং পরে অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষার্থীদের জন্য ফেসবুককে উন্মোচিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ১৩ বছরের বেশি বয়সী পৃথিবীবাসীর জন্য ফেসবুক উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। শর্ত একটাই- একটি ই-মেইল থাকতে হবে। বছর না ঘুরতে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন পাঁচ গুণ বেড়ে হয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। সিরিজ বি থেকে ফেসবুক জোগাড় করে ২৭.৫ মিলিয়ন ডলার।

এর মধ্যে ব্যক্তিগত প্রোফাইলের পাশাপাশি কোম্পানিও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতে শুরু করে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এ রকম পেজের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়

ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী মাইস্পেসকে কিনে নিয়ে মিডিয়া মোগল নিউজ কর্প বিনিয়োগ করবে সিলিকন ভ্যালিতে গুঞ্জন উঠল, ফেসবুক বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এরপরই বাজারে আসে ইয়াহুর নাম।বলা হয় ইয়াহু ফেসবুককে কিনতে চেয়েছে এক বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু তাতেও রাজি  হয় নি বোর্ড মেম্বার পিটার থিয়েল। তাদের অভ্যন্তরীণ হিসেবে ফেসবুকের ভ্যালুয়েশন ৮ বিলিয়ন ডলার। কারণ, ২০১৫ সালে তাদের আয় হবে ১ বিলিয়ন ডলার। ইয়াহুর পরে মাইক্রোসফট ও গুগল ফেসবুকের শেয়ার কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও মার্ক জাকারবার্গ এক বিবৃতিতে নিশ্চয়তা দেন যে তারা ফেসবুক বিক্রি করছেন না ।তবে অক্টোবর, ২০০৭-এ মাইক্রোসফটের কাছ থেকে ২৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নেয় ফেসবুক। বিনিময়ে মাত্র ১.৬% শেয়ার দিতে রাজি হয়। নভেম্বর মাসে হংকংয়ের ধনকুবের লি কা-সিং ফেসবুকে ৬০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন ।

বিভিন্ন বিনিয়োগ ও কর্মীদের স্টক অপশনের বদৌলতে ২০০৮ সালে ফেসবুকের ভ্যালুয়েশন দাঁড়ায় ৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৮ সালের মার্চ মাসে ফেসবুক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হিসেবে শেরিল স্যান্ডবার্গকে নিয়ে আসে গুগল থেকে। সেরিলের দায়িত্ব হয় ফেসবুকের বিজ্ঞাপনের লং টার্ম কৌশল ঠিক করা। কর্মীদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক এবং হাতে গোনা বিজ্ঞাপন দাতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ফেসবুক তার লং টার্ম বিজ্ঞাপনের পলিসি ঠিক করে। আসতে শুরু করে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো ক্যাশ ফ্লো ধনাত্মক হয়। ২০১১ সালে বিজ্ঞাপন খাতে আয় ৯০% বেড়ে ৩.৭১ বিলিয়ন পৌঁছায়। এর ফলে প্রথমবারের মতো লাভের অঙ্ক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৫৬% বিজ্ঞাপনই আসে আমেরিকা থেকে।

ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালের মধ্যে ফেসবুক হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় অনলাইন ফটো হোস্ট। ২০১১ সালের গ্রীষ্মে ফেসবুকে মানুষের ফটোর সংখ্যা ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।২০১২ সালের ফেসবুক নিজেদের অ্যাপ সেন্টার চালু করে। কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় ৫০০ গেমিং অ্যাপ সেখানে রিলিজ হয়।

ফেসবুকের যখন আবির্ভাব, তখন প্রবল প্রতাপে মাঠে ছিলো মাইস্পেস। ২০০৪ সালের শেষে ফেসবুকের যখন এক মিলিয়ন ব্যবহারকারী হয়নি, তখন মাইস্পেসের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ মিলিয়নের বেশি। এ ছাড়া ২০০৫ সালেই নিউজ কর্প মাইস্পেসকে কিনে নিয়ে সেখানে বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

কেন ফেসবুকের এতো দ্রুত সফলতা ?

সহজ-সুন্দর:

ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলাটা ছিল সহজ। এত সহজ যে কোনো টিউটোরিয়ালের দরকার হচ্ছে না ।  যার ফলে অনেক বেশি মানুষ ফেসবুক এর প্রতি আতকৃষ্ট হয় ।

প্রাইভেসি:

মাইস্পেসেও প্রাইভেসির একটা ভালো দিক ছিল।ফেসবুক প্রাইভেসির ব্যবস্থা এমন করেছে যে আপনার বিষয় আপনি ইচ্ছে করলে বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারবেন, আবার চাইলে আমজনতার জন্যও উন্মুক্ত করতে পারবেন।

নিউজফিড:

সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে ফেসবুক নিউজফিড উন্মোচিত করে (এখন ভাষ্য টাইমলাইন)। এটার বড় সুবিধা হলো একটি নির্দিষ্ট অ্যালগরিদমের ভিত্তিতে নিউজফিডে আমার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সেখানে দেখা যায়।

ডেভেলপার প্ল্যাটফর্ম:

শুরু থেকে ফেসবুক ফেসবুককে কেন্দ্র করে অ্যাপ্লিকেশন বানাতে আগ্রহীদের জন্য একটি ডেভেলপার নেটওয়ার্ক তৈরি করে দিয়েছে। এর ফলে ডেভেলপাররাই অনেক কিছু বানাতে শুরু করেন, যা একা ফেসবুকের পক্ষে সম্ভব ছিল

বিজ্ঞাপনদাতাদের নয়া মাধ্যমঃ

ফেসবুকের বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্ক হলো বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ। ফেসবুক তাদের সুযোগ করে দিচ্ছে দুই ভাবে। একটি হলো এই প্ল্যাটফর্মে আপনি বিনা খরচে আপনার পেজ বানাতে পারবেন এবং অর্গানিক্যালি নিজের প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবেন।

সর্বোপরি ফেসবুক এমন একটি স্টার্ট আপ যা গত ২০ বছর ধরে সফলতার শীর্ষে অবস্থান করছে । বর্তমানে পুরা বিশ্বে ৩ বিলিয়নেরও অধীক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয় বরং ফেসবুককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনলাইন বাজার এবং দিনে দিনে মার্কের ফেসবুক এখন অন্যতম ডেটা হাবে পরিণত হয়েছে ।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *